ফলসমূহকে গাছের প্রকৃতি এবং উৎপাদনের পদ্ধতির দিক হতে দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে ।
যথা- ১) অবৃক্ষ জাতীয় ফল এবং
২) বৃক্ষ জাতীয় ফল ।
অবৃক্ষ জাতীয় ফলের মধ্যে গুল্মজাতীয় (herbaceous) ফুটি, তরমুজ, স্টবেরি, আনারস ইত্যাদি । সিওডোস্টেম বা নকল কাণ্ড বিশিষ্ট কলা এবং রসালো কাণ্ড বিশিষ্ট পেঁপে প্রধান। বৃক্ষ জাতীয় ফলের মধ্যে সাইট্রাস গােেত্রর লেবু এবং মায়াটাসী গােেত্রর পেয়ারা প্রধান ফল ।
কলা চাষ
পৃথিবীতে প্রথম যে কটি ফলের আবাদ শুরু হয় কলা তার মধ্যে অন্যতম । মহামতি আলেকজান্ডার খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে সিন্ধু নদের উপত্যকায় কলার চাষ দেখতে পান । উষ্ণ ও আদ্র অঞ্চলের ফসল হচ্ছে কলা । এশিয়ার উষ্ণ ও আদ্র দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলেই কলার উৎপত্তিস্থল বলে অনেকে মনে করেন । অনেকের মতে আসাম-মিয়ানমার । ইন্দোচীন অঞ্চলই কলার উৎপত্তি স্থল। কলা যে বাংলাদেশের সর্ব প্রধান ফল কেবল তাই নয়, কলা পৃথিবীর সর্ব প্রধান ফল । বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৪০ হাজার হে, জমিতে কলার চাষ হয়। বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ৬ লক্ষ ২৮ হাজার টনের বেশি ।
জমি নির্বাচন
প্রচুর রৌদ্রযুক্ত, সুনিষ্কাশিত, জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ উর্বর দোঁআশ ও বেলে দোঁআশ মাটি কলা চাষের উপযোগী । কাকর, বেলে, ক্ষারীয় বা লবণাক্ত মাটি কলা চাষের অনুপযুক্ত। বাংলাদেশের পলি মাটিতে কলার ফলন সবচেয়ে ভালো হয় । যদিও কলা ফসল আবাদের জন্য অনেক পানির প্রয়োজন হয়, কিন্তু কলা জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে । কলার শিকড় যেহেতু মাটির ভিতর ৯০ সে. মি. পর্যন্ত প্রবেশ করে বেশীর ভাগ শিকড় মাটির ৪৫ সে:মি:-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তাই জৈব সার সমৃদ্ধ এবং পানি নিষ্কাশনের সুবিধাযুক্ত উঁচু জমি যেখানে বন্যার পানি আসেনা এবং বৃষ্টির পানি জমেনা কলা চাষের জন্য সবচেয়ে ভালো। ব্যবস্থাপনা ভালো হলে কলা চাষের জন্য মাটি কোন সমস্যা নয়। তবে মাটির পিএইচ ৪.৫ থেকে ৭.৫ এর মধ্যে হওয়া চাই।
গাছ রোপণের জন্য জমি ও গর্ত তৈরিকরণ
কলা আবাদের জন্য বারবার চাষ দিয়ে জমি ভালোভাবে তৈরি করে নিতে হয় । জমি তৈরির পর ষড়ভূজি রোপণ প্রণালি অনুসরণ করে জাত ভেদে ২×২ মি. বা ২×২.৫ মি: দূরত্বে কাঠি পুতে সাকার রোপণের জায়গা চিহ্নতি করা হয় । কাঠিকে কেন্দ্র করে ১মি.×১মি.×০.৭ মি. আকারের গভীর করে গর্ত খুড়তে হবে । এ সময় গর্ভের উপরের মাটি আলাদা রাখতে হবে। ১০-১৫ দিন গর্তটি উন্মুক্ত ফেলে রাখাই ভালো । প্রথমে জৈবসার আলাদা করে রাখা উপরের মাটির সাথে মিশিয়ে গর্তে ফেলতে হবে। এরপর মাটি দিয়ে গর্তটি সম্পূর্ণ ভরে ফেলতে হবে।
চারার সংখ্যা : কলার জাত ভেদে রোপণ দূরত্ব ও হেক্টর প্রতি চারার সংখ্যা দেয়া হলো ।
কলার জাত | গাছের উচ্চতা (সে.মি.) | রোপণের দূরত্ব (সে.মি.) | হেক্টর প্রতি চারার সংখ্যা |
১. অমৃত সাগর | ২১০-২৭০ | ১৮০ × ২৪০ | ২৩১৫ |
২. সবরী | ৩০০-৩৫০ | ২৪০ × ২৭০ | ১৫৪৩ |
৩. চাপা | ২৭০-৩৫০ | ২৪০ × ২৭০ | ১৫৪৩ |
৪. করবী | ২৪০-৩০০ | ২৪০ × ২৭০ | ১৫৪৩ |
৫. আনাজী | ২৭০-৩৪০ | ২৪০ × ২৭০ | ১৫৪৩ |
৬. কাবুলী | ১৫০-১৮০ | ১৫০ × ১৮০ | ৩৭০৪ |
চারা নির্বাচন ও রোপণ
কলা গাছের গোড়া থেকে যে তেউড় বের হয় তা দিয়ে এর বংশ বিস্তার করা হয়ে থাকে। কলার অসি চারা ও পানি চারা এই দুধরনের তেউড় বা চারা পাওয়া যায়। রোপণের জন্য অসিচারা উত্তম । কারণ এ চারা গাছের গোড়া হতে উঠে এবং পাতা সোজা, সরু ও শক্ত পড়নের হয়। চারার মূল গ্রন্থি সবল এবং মোটা থাকে। রোপণের পর এগুলো কম মরে এবং দ্রুত প্রতিষ্ঠিত হয়। পানি চারা সাধারণত পুরাতন গাছের পোড়া হতে পায় । এ চারা শক্ত ও ঘন চারার মাঝ খান দিয়ে গঙ্গার। চারার পাতা চওড়া, ছড়ানো, দুর্বল পড়নের হয়। এ চারার গোড়া চিকন এবং শিকড় দুর্বল প্রকৃতির হয়। জমিতে প্রতিষ্ঠিত হতে বেশি সময় লাগে, এমনকি রোপণের পর মরে যেতে পারে।
তবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর উভয় প্রকার চারার মধ্যে ব্যবধান থাকে না। কলার চারা অনেক বড় হওয়ার পরও রোপণ করা চলে তবে ছোট আকারের চারা উৎকৃষ্ট । বড় চারা প্রতিষ্ঠিত হতে বেশি সময় নেয় এবং এগুলোতে ফলনও তুলনামূলক কম । ৫-৫০ সে.মি. দীর্ঘ ও পুরু গোড়া বিশিষ্ট চারা রোপণের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট । বর্তমানে টিস্যু কালচারের মাধ্যমে চারা উৎপাদিত করে রোপণ করা হচ্ছে। মাতৃগাছ হতে আলাদা করার পর নির্বাচিত চারা দেরী না করেই রোপণ করা উচিত। রোপণের পূর্বে চারার গোড়ার সমস্ত পুরাতন শিকড় ছাঁটাই করে ডাইথেন এম ৪৫(০.২%) সলিউশনে ডুবিয়ে ছান্নায় শুকিয়ে নিতে পারলে খুব ভাল হয়। এরপর কন্দ গুলো মাটির ২০-২৫ সে.মি. গভীরে রোপণ করতে হবে ।
চারা রোপণের সময়
সেপ্টেম্বর -অক্টোবর (আশ্বিন-অগ্রহায়ণ) বা জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি (মাঘ-চৈত্র) কন্দ বা সাকার রোপণের জন্য উত্তম সময় । তবে সেচের ব্যবস্থা না থাকলে এবং বৃষ্টি নির্ভর হলে মৌসুম বৃষ্টির পর বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে কলার সাকার বা কন্দ রোপণ করা ভালো। শুকনো মৌসুমে বিশেষ করে জানুয়ারি - ফেব্রুয়ারি মাসে রোপণের পরপরই একটি সেচ খুবই উপকারী।
চারা প্রস্তুত ও রোপণ
চারা লাগানোর আগে পোড়া থেকে পুরাতন শিকড় এবং ১০-১৫ সে.মি. উপরের অংশ কেটে ফেলতে হবে। চারার গোড়ার মাতৃগাছের সাথে সংযোগকৃত দিকটি দক্ষিণ দিক রেখে রোপণ করতে হবে। এতে করে তার বিপরীত দিকে কলার কাদি হবে এবং সরাসরি কলার রোদ লাগতে পারবে না। এর ফলে কলার রং বিবর্ণ হওয়ার সুযোগ পাবে না এবং ঝড়ে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকবে ।
কলার চারা মাদার এমন ভাবে লাগাতে হবে যাতে চারার গোড়া বা মাথোর উপরের অংশ মাটির সমতল বরাবর থাকে এবং বাকি অংশটুকু মাটির নিচে থাকে । চারা সোজা হয়ে উঠার জন্য মাথোর চারদিকে মাটি চেপে দিতে হয় । প্রতি সারি মালার মাঝখান দিয়ে ৩০ সে.মি. চওড়া ও ২০ সে.মি. গভীর করে নালা তৈরি করে দিতে হয় । মালার মাটি দুই পাশে উঠিয়ে দিলে কলা গাছের সারি বেডের মত হয়। তাতে বৃষ্টি হলে গাছের গোড়ার পানি দাঁড়াতে পারবে না । এমনকি অতিরক্তি বৃষ্টির পানি ঐ নালা দিয়ে সহজেই বের হয়ে যেতে পারবে ।
সার প্রয়োগ কৌশল
রোপণের ১ মাস পূর্বে গর্তে এবং রোপণের পর সুষম সার প্রয়োগ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। সারের হিসাব গাছ প্রতি করাই ভালো । জৈব বা গোবর সার ১২-১৫ কেজি, ইউরিয়া ১২০ গ্রাম টিএসপি ২৫০ গ্রাম এমপি ১২০ গ্রাম, জিপসাম ১১০ গ্রাম এবং জিংক সালফেট ২৫ গ্রাস দেয়ার সুপারিশ করা হয় । জমি তৈরির শেষ পর্যারে গাছ প্রতি হিসাব করে অর্ধেক গোবর সার জমিতে ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। ২x২ মি. দূরত্বে সাকার রোপণ করলে ২৫০০ গাছের জন্য ৩০ টন গোবর সার প্রয়োজন । এর অর্ধেক জমি তৈরির শেষ পর্যায়ে জমিতে ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি অর্ধেক গোবর সার এবং সম্পূর্ণ টিএসপি, জিপসাম এবং জিংক সালফেট চারা রোপণের আগে গর্তের উপরের ২৫ সে.মি. মাটির সাথে মিশাতে হবে। চারা রোপণের ২ মাস পর থেকে শুরু করে ইউরিয়া ও এমপি সার সমান হয় কিস্তিতে দু মাস পর পর উপরি প্রয়োগ (Top dressing) করতে হয়। এগুলো কলা বাগানে ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশাতে হয়। মাটিতে “লো” থাকলেই সার ছিটাতে ও মিশাতে হয় ।
নচেৎ সার প্রয়োগের পর সেচ দিতে হবে । বি এ আর সি কর্তৃক প্রণীত সার ম্যানুয়েল অনুযায়ী কলা চাষে নিম্ন সারণি অনুসারে সার প্রয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে ।
সারণি: কলার চারা লাগানোর প্রাক্কালে সার প্রয়োগের পরিমাণ
উলেখিত সারের সুপারিশ অনুসারে ৫০% গোবর বা আবর্জনা পচা সার জমি তৈরির সময় এবং বাকি ৫০% গর্ভে দিতে হবে। এ সময় অর্ধেক টিএসপি গর্তে প্রয়োগ করতে হবে। রোপণের দেড় থেকে দুই মাস পর ২৫% ইউরিয়া ৫০% এমপি ও বাকি টিএসপি জমিতে ছিটিয়ে ভালো ভাবে কুপিয়ে মাটির সাথে মিশায়ে দিতে হবে । এর দুই থেকে আড়াই মাস পর গাছ প্রতি বাকী ৫০% এমপি ও ৫০ % ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে । ফল আসার সময় অবশিষ্ট ২৫% ইউরিয়া জমিতে ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে ।
গাছ রোপণ পরবর্তী পরিচর্যা
কলা গাছের জন্য গাছ রোপণ পরবর্তী পরিচর্যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু কলা গাছ লাগালে থেকে কলা পরিপক্ক হওয়া পর্যন্ত অনেক সময় লাগে, সেহেতু প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বহুবিধ পরিচর্যার মাধ্যমে ভালো ফলন আশা করা যেতে পারে। রোপণ পরবর্তী পরিচর্যার বিভিন্ন দিক নিচে আলোচনা হলো ।
ক) আগাছা পরিষ্কার: কলা বাগান সব সময় আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। কলার শেকড় মাটির উপরিভাগে ১৫-২০ সে:মি: এলাকায় কেন্দ্রীভূত থাকে । তাই আগাছা দমনের জন্য কোদাল ব্যবহার করলে অগভীর কোপ দিতে হবে। বয়স্ক পাতা শুকিয়ে গেলে কেটে ফেলা উত্তম। কারন এগুলো পাকা মাকড় ও রোগ বিস্তারে সহায়ক ।
খ) সেচ ও নিকাশ: শুক মৌসুমে ক্ষেতে ২-৩ বার করে পাবন সেচ দিতে হবে। নতুবা গাছ দুর্বল হয়ে যাবে এবং শেষ পর্যন্ত ফলন কমে আসবে! বর্ষাকালে বাগানে যাতে পানি জমে না থাকে তার ব্যবস্থা করতে হবে । পানি বের করার জন্য নির্দিষ্ট দূরত্বে নালা কেটে দিতে হবে ।
গ) তেউর উৎপাটন: চারা রোপণের কয়েক মাস পরই এর গোড়ার চারি পার্শ্বে তেউড় বের হতে থাকে । এসব চারা কলা গাছে থারে বের হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কয়েকদিন পর পর মাটি বরাবর ৫ সে.মি. উপরে ধারালো হাসুয়া দিয়ে কেটে দিতে হবে । মুড়ি ফসল উৎপাদন করতে চাইলে ফুল আসার সময় প্রতি গাছে একটি ভাল চারা রেখে বাকি গুলো কেটে দিতে হবে।
ঘ) গাছে ঠেকনা দেয়া: গাছে থাড়ে আসার পরপরই কঁদি যখন বড় হয় তার ভারে অথবা ঝড়ের দরুন মাঝারি ও দীর্ঘকায় জাতের কলা গাছ যাতে পড়ে বা ভেঙ্গে না যায় সেজন্য বাঁশের খুটি দ্বারা বাতাসের বিপরীত মুখে গাছে ঠেস দিতে হয়।
ড) মাটি তোলা: বর্ষাকালে যখন অতিরিক্ত বৃষ্টির ফলে গাছের গোড়া থেকে মাটি ধুয়ে যায় এবং গোড়ার শিকড় বেরিয়ে পড়ে তখন গোড়ায় মাটি তুলে দেওয়া উচিত । গাছের গোড়ায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলে মূল পচে যেতে পারে । এ জন্য সারির দু পাশে নালা তৈরি করে গাছের গোড়ার মাটি তুলে দিতে হয়।
চ) থোর অপসারণ: কাঁদি ঢাকা ও মোচা থেকে কলা বের হওয়ার পর শেষোক্ত কলার ৪-৫ সে.মি. নিচে খোড় (ফুল/মোচা) কেটে দিতে হবে। সুর্যালাকে, গরম বাতাস, ধুলাবালি, পাকামাকড়, পাখি ইত্যাদির হাত থেকে কঁদিকে রক্ষা ও কলার রং উজ্জ্বল রাখার জন্য নীল পলিথিন বা অন্য কোন স্বচ্ছ ব্যাগ দ্বারা কঁদি ঢেকে দিতে হৰে ।
পোকামাকড় ও রোগ বালাই দমন
কলার পাতা ও ফলের বিটল পোকা
কলার পাতা যখন কঁচি অবস্থায় থাকে তখন এ পোকা কচি পাতা খেয়ে থাকে। তারপর কলার মোচা বের হওয়ার সাথে সাথে পাতা ছেড়ে কচি কলা আক্রমণ করে এবং কলার খোসা ফেঁছে খায় । এতে কচি কলার গায়ে দাগ পড়ে । কলা বড় হওয়ার সাথে সাথে দাগগুলো আকারে বড় হয় এবং কালচে বাদামি রং ধারণ করে । আক্রান্ত কলা দেখতে কুৎসিত হয় এবং বাজারদর কমে যায় ।
কলাকে রক্ষা করতে হলে ছড়িতে কলা বের হওয়ার পূর্বেই ৪২ ইঞ্চি লম্বা ও ৩০ ইঞ্চি গ্রন্থের দুমুখ ভালো একটি পলিথিন ব্যাগের এক মুখ মোচার ভেতর ঢুকিয়ে বেধে দিতে হবে। অন্য মুখ খোলা রাখতে হবে। বাতাস চলাচলের জন্য পলিথিন ব্যাগটিতে ২০-৩০টি ২ সে:মি: বাসের ছিদ্র রাখা বাঞ্চনীয়। ডাইএলড্রিন/এলড্রিন পানির সাথে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করলে ভাল প্রতিকার পাওয়া যায়। রাষ্ট্রট্রিপ এর আক্রমণে ফলের উপর ধূসর লাল বনের বলয় সৃষ্টি হয় এবং ফলের খোল ফেটে যায়। কলার ছড়া পাতলা চট অথবা পলিথিন দ্বারা ঢেকে রাখলে ভাল ফল পাওয়া যায় । ছড়াতে ১৫ দিন পর পর ডায়াজিনন (২%) সিঞ্চন করলেও উপকার পাওয়া যায় ।
পানামা: এটি একটি ছত্রাক জাতীয় মারাত্মক রোগ। এ রোগের আক্রমণে প্রথমে বয়স্ক পাতার কিনারা হলুদ হয়ে যায় এবং পরে কচি পাতাও হলুদ রং ধারণ করে । পরবর্তীতে পাতা বোটার কাছে ভেঙে গাছের চারি দিকে ঝুলে থাকে এবং মরে যায় কিন্তু সবচেয়ে কচি পাতাটি গাছের মাথায় খাড়া হয়ে দাড়িয়ে থাকে । অবশেষে গাছ মরে যায় । কখনও কখনও গাছ লম্বা লম্বিভাবে ফেটেও যায় । আক্রান্ত গাছ গোড়াসহ উপড়িয়ে মাটি চাপা দিতে হবে এবং আক্রান্ত জমিতে ৩/৪ বছর কলা চাষ কধ রাখতে হবে ।
কলার বানচি টপ - ভাইরাস রোগ
ইহা একটি ভাইরাস জাতীয় রোগ এবং কলার জন্য খুবই ক্ষতিকর । এ রোগের আক্রমণে গাছের বৃদ্ধি হ্রাস পায় এবং পাতা গুচ্ছা কারে বের হয় । পাতা আকারে খাটো, অপ্রশস্থ এবং উপরের দিকে খাড়া থাকে । কচি পাতার কিনার উপরের দিকে বাঁকানো এবং সামান্য হলুদ রঙের হয়। অনেক সময় পাতার মধ্য শিরা ও বোটায় ঘন সবুজ দাগ দেখা যায় । আক্রান্ত গাছ গোড়াসহ উঠিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। এ রোগ বিস্তারের সহায়ক জাব পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য অনুমোদিত মাত্রায় কীটনাশক (সেভিন ব্যবহার করতে হবে ।
পাতার দাগ বা সিগাটোকা রোগ
এ রোগের আক্রমণে প্রাথমিকভাবে ৩য় ও ৪র্থ পাতায় ছোট ছাট হলুদ দাগ দেখা দেয়। ক্রমশ দাগগুলো বড় হয় ও বাদামি রং ধারণ করে । এভাবে একাধিক দাগ মিলে বড় দাগের সৃষ্টি করে এবং তখন পাতা পুড়ে যাওয়ার মত দেখায় । রোগের প্রাথমিক অবস্থায় বোর্দো মিশ্রণ প্রয়োগ করে দমন করা যায়। জমিতে সুষ্ঠ নিকাশ ব্যবস্থা ও আগাছা পরিষ্কার রাখতে হবে । ফল সংগ্রহের পর রোগাক্রান্ত পাতা পুড়ে ফেলতে হবে ।
ফল সংগ্রহ ও সরক্ষণ
কলার জাত, রোপণের সময়, আবহাওয়া ও পরিচর্যার উপর চারা রোপণ হতে কাঁদি কাটা পর্যন্ত সময়ের তারতম্য ঘটে । রোপণের পর থেকে শুরু করে ফুল বের হওয়ার পর কলা আহরণের উপযুক্ত হতে ১০০ থেকে ১৩০ দিন সময় লাগে । কলা পরিপক্ক হলে এর শিরাগুলো সমান হয়ে যায় এবং ফ্যাকাশে সবুজ রং ধারণ করে। কলা পাকার অপেক্ষা করে এ সময়ে কঁদি কেটে নামানা েহয় এবং কলা গাছ কেটে দূরবর্তী স্থানে নিয়ে ফেলে দিতে হয় । এরপর ফলগুলো এক এক করে পৃথক করে ঘরে খড়ের ওপর এক বা দুসারিতে করে সাজিয়ে আবার খড় দিয়ে ঢেকে দিতে হয় । এতে কলা সমানভাবে পাকে এবং চমৎকার রং হয় । হেক্টর প্রতি সাধারণত ২০-২৫ টন ফলন পাওয়া যায় ।
পেঁপে চাষ
পেঁপে চিরহরিৎ শ্রেণির গাছ এবং সারা বছরই ফুল ও ফল দিয়ে থাকে । পৃথিবীর বহু দেশেই পেঁপের চাষ হয় । বাংলাদেশেও পেঁপে খুবই জনপ্রিয় । পেঁপের কতগুলো বৈশিষ্ট্য রয়েছে । প্রথমত: এটা স্বল্প মেয়াদি, দ্বিতীয়ত, এটা কেবল ফলই নয় সবজি হিসেবেও এর ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে । তৃতীয়ত, পেঁপে অত্যন্ত সুস্বাদু, পুষ্টিকর এবং ঔষধি গুণসম্পন্ন । চতুর্থত, বাংলাদেশে যেখানে দীর্ঘমেয়াদী ফল লাগানোরে স্থানের অভাব প্রকট, সেখানে যে কোন কৃষকের পক্ষে দুচারটা পেঁপে গাছ লাগানো সম্ভব ।
মাটি ও জমি নির্বাচন
সাধারণত উঁচু বেলে দোঁ-আশ বা দো-আশ মাটিতে পেঁপের ফলন ভালো হয় । পেঁপে চাষের জন্য পানি সেচের ভাল ব্যবস্থা থাকা চাই । তবে যেখানে পানি দাড়ানোর সম্ভাবনা আছে সে সব জমিতে পেঁপের চাষ করা উচিত নয় । কারণ গাছ কয়েক ঘণ্টা পানি দাড়ানো অবস্থা সহ্য করতে পারে না । মাটির গভীরতা বেশি হলে গাছ দ্রুত বাড়ে তবে অপেক্ষাকৃত অগভীর জমিতেও পেঁপে চাষ করা চলে । অধিক অম্ল বা অধিক ক্ষার মাটিতে পেঁপে ভালো হয় না । মাটির পিএইচ ৭.০ এর কাছাকাছি পেঁপে চাষের জন্য ভালো ।
জমি ও গর্ত তৈরি
উঁচু, খোলামেলা, নিষ্কাশন ব্যবস্থা সম্পন্ন জমি, জো বুঝে ৩/৪ বার চাষ ও মই দিয়ে ভালোভাবে তৈরি করতে হবে । আগাছা ভালো করে পরিষ্কার করে মাটি ঝুরঝুরে ও সমতল করতে হবে। গর্ত খনন: ষড়ভুঞ্জী রোপণ পদ্ধতি অনুসরণ করে জাত ভেদে ২×২ মি: দূরে ৬০×৬০×৬০ সে. মি. আকারের গর্ত খনন করে গর্তে ২০-২৫ কেজি পচা গোবর, ১ কেজি খৈল, ২০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৩০০ গ্রাম টিএসপি ও ২০০ গ্রাম এমপি সার প্রয়োগ করতে হতে । মাদা তৈরি করে পানি দিয়ে ভিজিয়ে ১০-১৫ দিন রাখার পর চারা রোপণ করা উচিত। এতে গর্তের রোগ জীবাণু ও পোকা নষ্ট হয় । এরপর গর্তের মাটির সাথে মৌল সার মিশিয়ে গর্তে প্রয়োগ করা হয় । মাটিতে রস থাকলে এক সপ্তাহের মধ্যে মৌল সারের বিক্রিয়া শেষ হয়ে যায় । চারা লাগানোর পূর্বে গর্তের মাটি কুপিয়ে জমির সমতল হতে ১৫ সি.মি. উঁচু করে মাদা তৈরি করতে হয় । তাতে বৃষ্টির পানি সহজে গড়ায়ে যাবে এবং গাছের বৃদ্ধির জন্য সহায়ক হবে । কেননা পেঁপে গাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না ।
বীজের হার
দুই মিটার দূরে দূরে সারি করে প্রতি সারিতে ২ মিটার দূরত্বে চারা রোপণ করলে ১ হেক্টর জমিতে ২৫০০ গাছের জন্য ৭৫০০ টি চারার প্রয়োজন হয়। সদ্য সংগৃহীত বীজ হলে ১৪০-১৬০ গ্রাম বীজ দিয়ে প্রয়োজনীয় চারা তৈরি করা যায় । পুরাতন বীজ হলে ২৫০-৩০০ গ্রাম বীজ লাগবে ।
চারা তৈরি
বীজ থেকে তৈরি চারা গাছ লাগিয়ে পেঁপে চাষ করা হয়। বীজ তলায় বীজ বুনার দুইমাস পর চারাগুলো ১০ সে:মি: : বড় হলে জমিতে রোপণ করা যেতে পারে । পলিথিন ব্যাগে চারা তৈরি করলে রোপণের পর চারা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ১৫×১০ সে:মি: আকারের পলি ব্যাগে সমপরিমাণ বালি, মাটি ও পঁচা গোবর মিশ্রণ ভর্তি করে ব্যাগের তলায় ২ ৩ টি ছিদ্র করতে হবে। তারপর এতে সদ্য সংগৃহীত বীজ হলে ১টি এবং পুরাতন বীজ হলে ২-৩ টি বীজ বপণ করতে হবে। একটি ব্যাগে একের অধিক চারা রাখা উচিত নয় । ২০-২৫ দিন বয়সের চারা গাছে ১-২ % ইউরিয়া মিশ্রিত পানি স্প্রে করলে চারার বৃদ্ধি ভালো হয়
চারা রোপণ পদ্ধতি
দেড় থেকে ২ মাস বয়সের চারা রোপণ করা হয় । ২ মিটার দূরে দূরে ৬০×৬০×৬০ সে.মি. আকারের গর্ত করে রোপণের ১৫ দিন পূর্বে গর্তের মাটিতে সার মিশাতে হবে । পানি নিষ্কাশনের জন্য দুই সারির মাঝখানে ৫০ সে:মি: নালা রাখতে হবে।
রোপণের সময়
চারা রোপণের জন্য সেচের সুবিধা থাকলে সেপ্টেম্বর- অক্টোবর (আশ্বিন) এবং জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি (মাঘ উপযুক্ত সময় । নচেৎ মৌসুমী বৃষ্টি শুরু হলে জ্যৈষ্ঠ মাস উত্তম। প্রতিটি গর্তে ৩টি করে চারা ২০ সে.মি. দূরত্বে ত্রিভূজাকারে রোপণ করতে হবে । চারা বিকালে রোপণ করাই ভালো। রোপণের পরপরই সেচ দেয়া ভালো । এরপর যতদিন না চারা লেগে উঠে তত দিন সেচ দেয়ার প্রতি যত্নবান হতে হবে। শুষ্ক মৌসুমে ১৫-২০ দিন পর পর সেচের প্রয়োজন হতে পারে।
সার প্রয়োগ পদ্ধতি: প্রতিটি পেঁপে গাছে নিম্নরূপ সার ব্যবহার করতে হবে
সারণি: পেঁপে চাষে সার প্রয়োগের পরিমাণ
পেঁপে চাষের জন্য গাছ প্রতি ১০ কেজি জৈব সার, ৪৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ৫০০ গ্রাম টিএসপি, ৪৫০ গ্রাম এমপি ২৪০ গ্রাম জিপসাম, ৬ গ্রাম জিংক অক্সাইড বা ১৫ গ্রাম জিংক সালফেট এবং বারোক্স বা রোরিক অ্যাসিড ২৫ গ্রাম দেয়া প্রয়োজন । জমি তৈরির শেষ চাষের সময় গাছ প্রতি ৫ কেজি জৈব সার হিসেব করে সম্পূর্ণ জমিতে ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে । বাকী গোবর বা জৈব সার এবং সম্পূর্ণটি এসপি, জিপসাম, জিংক অক্সাইড বা জিংক সালফেট ও বরিক অ্যাসিড বা বারাক্স ভিত্তি সার হিসেবে চারা রোপণের পূর্বে গর্তের উপরে ২৫ সে:মি: মাটির মধ্যে কোদাল দিয়ে মিশাতে হবে । চারা লাগানোর পর গাছে নতুন পাতা আসলে ইউরিয়া ও এমপি সার ৫০ গ্রাম করে প্রতি এক মাস অন্তর প্রয়োগ করতে হবে । গাছে ফুল আসলে এ মাত্রা দ্বিগুণ করা হয় । শেষ ফল সংগ্রহের এক মাস পূর্বেও সার প্রয়োগ করতে হবে। পচা গোবর, টিএসপি, জিপসাম, বারোক্স এবং জিংক সালফেট গর্ত তৈরির সময় প্রয়োগ করতে হবে ।
রোপণ পরবর্তী পরিচর্যা
পেঁপে খুবই স্পর্শকতার গাছ। রোপণ পরবর্তী নিম্নলিখিত পরিচর্যা গুলি অনুসরণ করলে কাঙ্ক্ষিত ফলন নিশ্চিত করা যায় ।
অতিরিক্ত গাছ অপসারণ
চারা রোপণের ৪-৫ মাস পর থেকেই গাছে ফুল আসা শুরু করে। ফুল দেখে কোনটি স্ত্রী, কোনটি পুরুষ গাছ চেনা যায় । ফুল আসার পর এ সময় প্রতি গর্তে লাগানো ৩টি চারার মধ্যে একটি করে সতেজ, সবল সুস্থ স্ত্রী গাছ রেখে আর সব গাছ সে স্ত্রী হাকে বা পুরুষ হাক উপড়ে তুলে ফেলতে হবে । তবে প্রতি ২০টি গাছের জন্য একটি করে পুরুষ গাছ রাখতে হবে যাতে পরাগায়ণে সুবিধা হয় । পরাগায়ন ছাড়া সব স্ত্রী ফুল ঝরে পড়ে যাবে, ফল ধরবে না ।
আগাছা পরিষ্কার
বাগান সব সময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে । গাছের গোড়ায় মাটি নিড়ানি দিয়ে ঝুরঝুরে করে দিতে হবে । আগাছা পরিষ্কারের সময় লক্ষ রাখতে হবে যেন কোন সময় গভীরভাবে গাছের মাটি খোড়া না হয় । কারণ পেঁপে গাছের শিকড় মাটির গভীরে যায় না ।
সেচ ও নিষ্কাশন
শুষ্ক মৌসুমে বা খরার সময় পানি সেচ দিলে পেঁপের ফলন বৃদ্ধি পায় । শীতকালেও গ্রাম্মকালে ২০-২৫ দিন পর পর সেচ দেয়া দরকার। প্রত্যেক বার সার দেয়ার পর সেচ দিতে হয় । পেঁপে জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না । লক্ষ রাখতে হবে যেন গাছের গোড়ায় পানি জমে না থাকে ।
ফল পাতলাকরণ
পেঁপে গাছের প্রতি পর্বে ফল আসে । অনেক ক্ষেত্রে প্রতি পর্বে একটির পরিবর্তে এক সাথে বেশ কটি ফল আসে এবং এগুলো যথাযথভাবে বাড়তে পারে না । এসব ক্ষেত্রে ছোট অবস্থাতেই প্রতিপর্বে দু-একটি ফল রেখে আর সব ফল তুলে বা ছিড়ে ফেলতে হয় । এতে ফলের আকার বড় হয় এবং গুণগত মান বৃদ্ধি পায় ।
পোকা মাকড় ও রোগ দমন
ফলের মাছি পোকা কচি পেঁপের গায়ে ডিম পাড়ে। ফলে পেঁপে পচে নষ্ট হয়। এক আউন্স ডিটরেক্স ৮০ ১২ কেজি পানিতে মিশিয়ে ৮ দিন পর পর স্প্রে করে এ পোকা দমন করা যায়
পেঁপের মোজাইক ভাইরাসজনিত রোগ
রোগের আক্রমণে পাতা কুঁকড়ে যায় । পাতায় সাদা হলদেটে দাগ দেখা যায়। ক্লোরপ্লাস্ট নষ্ট হয়ে পাতায় ছিট ছিট হলুদ মোজাইক দাগ পড়ে এবং গাছের বৃদ্ধি থেমে যায়। গাছ ফল ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে । রোগের আক্রমণ দেখা মাত্র গাছ ধ্বংস করতে হবে। ১১.৫ মিমি: ডায়াজিনন ৫০ ইসি, ১২ কেজি পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করলে ভাইরাস বাহক কীটপতঙ্গ ধ্বংস করে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায় ।
গোড়া পচা: এ রোগে আক্রান্ত গাছের কাণ্ড মাটি সংলগ্ন স্থানে পচে গিয়ে গাছ মারা যায় ও সেখান থেকে দুর্গন্ধ বের হয় । মাটিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলে এই রোগ হয়। মাটি সুনিষ্কাশিত রাখা রোগ ঠেকিয়ে রাখার প্রধান উপায় । প্রতিরোধক ব্যবস্থা হিসেবে ডাইথেন এম-৪৫ প্রয়োগ করা যেতে পারে ।
ফল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
ফল ধরার ২ মাস পরে সবজি হিসেবে পেঁপে সগ্রহ করা যায় । অর্থাৎ চারা রোপণের ৬-৭ মাস পর কঁচা পেঁপে তালো যায় । তবে পেঁপে গাছের প্রথম ফল ৯-১০ মাসের মধ্যে পাওয়া যায় । পাকা ফলের জন্য চামড়া কিঞ্চিৎ হলুদ হলে সংগ্রহ করা ভালো । ফলের গায়ে আঁচড়া দিলে দুধের মত কষ বের হয় । ফলের ঐ দুগ্ধবত কষ পাতলা ও জলীয় ধারন করলে বুঝতে হবে যে পেঁপে পরিপুষ্ট হয়েছে। প্রতিটি ফল হতে দিয়ে আলাদা আলাদাভাবে পাড়া সবচেয়ে ভাল । এতে ফলে আঘাত লাগে না। সেংগৃহীত ফল ঠান্ডা স্থানে রাখলে ধীরে ধীরে পাকে । তবে ইথিলিন গ্যাসের সাহায্যে দ্রুত পাকানো যায় । কাচা বা পরিপুষ্ট ফল ৯° থেকে ১০° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ও ৮০-৮৫ ভাগ আদ্রতায় ২ সপ্তাহ রাখা যায় । গাছের যথোপযুক্ত পরিচর্যা নেয়া হলে এক গাছ থেকে ২-৩ বছর পর্যন্ত ফল পাওয়া যায় । কিন্তু পেঁপে গাছ ৩ বছরের বেশি রাখলে লাভজনক হবে না ।
পেয়ারা চাষ
বৃক্ষ শ্রেণির ফলের মধ্যে যে গাছ হতে রোপণের পর ন্যূনতম সময়ের মধ্যে ফল পাওয়া যায় তা পেয়ারা । পেয়ারা এমন একটি ফল যার মধ্যে একাধিক গুণের বিরল সমন্বয় ঘটেছে যা খুব কম ফলেই লক্ষ করা যায় । এটি দ্রুত বর্ধনশীল এবং অপেক্ষাকৃত কম যত্নেই যে কোন স্থানে জন্মানো যায়। এটি অত্যন্ত ফলনশীল এবং পুষ্টি মান ও স্বাদের দিক দিয়ে উৎকৃষ্ট ।
মাটি ও জমি নির্বাচন
পেয়ারা গাছ বেশ শক্ত। সব রকম মাটিতেই পেয়ারা জন্মাতে পারে। তবে হালকা বেলে দোঁআশ হতে ভারী এটেল মাটি পেয়ারা উৎপাদনের জন্য উত্তম । তবে পানি নিকাশের সুবিধাযুক্ত উর্বর গভীর পলি মাটিও পেয়ারা চাষের জন্য উত্তম । অল্প অন্ন ও অল্প ক্ষারযুক্ত মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকলে পেয়ারা ভালো হয় ।
পেয়ারা গাছ সাধারণত জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না । তবে পেয়ারা গাছ স্বল্প সময়ের জন্য জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে । কিন্তু তাতে ফল ধারণে অসুবিধা হয়। পেয়ার গাছ সাধারণত লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে না । এ ছাড়া স্যাঁতসেঁতে মাটিতে পেয়ারা ভালোভাবে জন্মাতে পারে না । মাটির পি এইচ ৪.৫ থেকে ৮.২ পর্যন্ত হলেও পেয়ারা আবাদ সফল হতে পারে। পেয়ারা গাছের শিকড় মাটির মাত্র ২০ সে.মি.-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ । পেয়ারা গাছ অগভীর মূল বিশিষ্ট হওয়ায় ৯০ সে:মি: গভীর মাটিতেও চাষ করা যায়। উঁচু জমি ও খোলামেলা রৌদ্রযুক্ত স্থান পেয়ারা চাষের জন্য উপযাগী । তবে সামান্য রোদ বা আংশিক ছায়াযুক্ত স্থানেও পেয়ারা ভালো ফলন দিতে পারে । অধিক আর্দ্র এবং আংশিক ছায়াযুক্ত স্থানে জন্মানো ফলের মিষ্টতা কম হয় । পেয়ারা বড় গাছে ৪৫ সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। তবে বেশি তাপমাত্রায় ফল ঝরে যায় আবার খুব শীতে গাছ মারা যায়। সমতল ও পাহাড়ি উভয় এলাকায়ই পেয়ারা ভালো জন্মাতে পারে ।
জমি ও গর্ত তৈরি
চারা লাগানোর কমপক্ষে এক মাস পূর্বে জমিতে ২-৩ বার লাঙ্গল দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। জমি আগাছামুক্ত ও সমতল করে নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় গর্ত খনন করতে হবে । বর্গাকার প্রণালিতে ৪-৫ মিটার দূরে দূরে ৫০×৫০×৫০ সে:মি: আকারের গর্ত তৈরি করতে হবে। প্রতি গর্তে ১০ কেজি গোবর, ২০০ গ্রাম টিএসপি, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ২০০ গ্রাম মিউরেট অব পটাশ প্রয়োগ করতে হবে ।
চারা রোপণের সময়
জমিতে পানি সেচের ব্যবস্থা থাকলে পেয়ারা গাছ এপ্রিল মে থেকে শুরু করে সেপ্টেম্বর (আশ্বিন কার্তিক - মাস পর্যন্ত অর্থাৎ বছরের যে কোন সময়ই লাগানো যায় । তবে পেয়ারা গাছ যে- জুলাই (জ্যৈষ্ঠ - শ্রাবণ) মাসে লাগানোই উত্তম । রোপণের পরবর্তীকালে সার প্রয়োগের জন্য আগস্ট- সেপ্টেম্বর মাস উত্তম ।
রোপণ পদ্ধতি
গর্ভের মাটি আলগা করে গর্তের মাঝখানে চারা বসায়ে চারদিকের মাটি ভালোভাবে চেপে দিতে হবে । চারা লাগানোর পর কাঠি দিয়ে চারা বেঁধে দিতে হবে, যাতে গাছ সোজা থাকে। পেয়ারা গাছ বর্গাকার, আয়তকার বা ত্রিভুজাকার পদ্ধতিতে লাগানো যায় । চারা রোপণের পর বৃষ্টি না হলে পানি দেয়া অব্যাহত রাখতে হবে । যতদিন পর্যন্ত চারা গাছ লেগে না উঠে তবে সাধারণত গাছ লেগে উঠতে প্রায় একমাস সময় লাগে। চারা রোপণের পর গোড়ায় যাতে পানি জমে না থাকে সে জন্য গোড়ার মাটি কিছুটা উঁচু করে দিতে হবে ।
সার প্রয়োগ
পেয়ারা ফসল থেকে উচ্চ ফলন প্রাপ্তি অব্যাহত রাখতে হলে নিয়মিত নিম্নরূপ হারে প্রতি গাছে সার প্রয়োগ করতে হবে ।
সারণিতে উলেখিত সার দুই কিস্তিতে দিতে হবে । বর্ষা শুরুর আগে বৈশাখ - জ্যৈষ্ঠ মাসে প্রথম কিস্তিতে সম্পূর্ণ গোবর সার ও টিএসপি এবং অর্ধেক ইউরিয়া ও এমপি সার গাছের চারদিকে ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে । তবে পাহাড়ের ঢালে ডিবলিং পদ্ধতিতে সার দেয়াই ভালো । দ্বিতীয় কিস্তি সার বর্ষা মৌসুমের শেষে ভা -আশ্বিনে দিতে হয় । এ সময় বাকি অর্ধেক ইউরিয়া ও এমপি সার দেয়া হয় । নির্ধারিত মাত্রায় যথা সময়ে সার প্রয়োগ করতে হবে ।
সারণি -১ এ বর্ণিত সার ছাড়াও কখনও কখনও জিংক বা সালফার বা মলিবডেনামের অভাব দেখা দিতে পারে । এগুলোর অভাবে গাছের পাতা ছোট হতে পারে, পাতার শিরার মধ্যবর্তী জায়গার সবুজ কমে যেতে পারে । পাতা ও ফলের সংখ্যা কম হতে পারে ইত্যাদি । এক্ষেত্রে নির্ধারিত মাত্রায় জিংক সালফেট, জিপসাম বা বরিক অ্যাসিড প্রয়োগ করা যেতে পারে ।
রোপণ পরবর্তী পরিচর্যা
যদিও পেয়ারা গাছ বেশ খরা সহ্য করতে পারে তথাপি আশানুরূপ ফলন পেতে হলে শুষ্ক মৌসুমে দোআশ মাটিতে ১৫ দিন পরপর সেচ দিতে হবে এবং শীতকালে ৩ থেকে ৭ দিন অন্তর অন্তর সেচ দেয়ার প্রয়োজন হবে । তবে ভারী মাটিতে ১৫-২০ দিন অন্তর সেচের প্রয়াজন হয় । পেয়ারা বাগানে গাছের সারির মাঝখান দিয়ে হালকা চাষ দিয়ে আগাছা ও ঝরাপাতা মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে । এতে মাটির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি পাবে ।
সাথী ফসল
পেয়ারা গাছ বড় হয়ে পূর্ণ ফলবান হতে ৭-৮ বছর সময় লাগে । জমির লাভজনক ব্যবহারের জন্য এ সময় পেয়ারা বাগানে বিভিন্ন শাক-সবজি, কন্দাল জাতীয় ফসল, ডালশস্য ইত্যাদি চাষ করা যায় । তবে সাথী বা আন্তঃফসল করা হলে তার জন্য অতিরিক্ত সার দেয়ার প্রয়োজন হবে ।
শাখা বিন্যাস ও ছাঁটাইকরণ
গাছ শাখা প্রশাখা ছাড়ার আগে প্রধান কাণ্ড অন্তত এক মিটার লম্বা হতে দিতে হয় । এরপর প্রধান কাণ্ডটির মাথা কেটে দিলে মাথার চারদিকে অনেক কুঁড়ি গজায় । এগুলো থেকে চারটি কুঁড়ি রেখে বাকিগুলো ভেঙে দিয়ে শুধু এ চারটিকে বাড়তে দিতে হবে ।
কুঁড়ি চারটি যেন খাড়াভাবে উঠতে না পারে সেজন্য ভার দিয়ে বা রশি বেধে মাটির সমান্তরাল করে দিতে হবে অথবা এই চারটি কুঁড়ি শাখায় রূপান্তর হয়ে যেন সোজা উপরের দিকে না উঠে চারদিকে প্রসারিত হয় সেজন্য অনেক সময় খুঁটি পুঁতে রশি দিয়ে বেধে দিতে হবে। এ শাখাগুলো যখন ৫০ সে.মি. বা এক মিটার লম্বা হবে তখন সে শাখার আবার মাথা কেটে দিতে হবে। এভাবে আর একবার শাখার মাথা কেটে দিয়ে আবার ২টি করে কুঁড়ি বা শাখা রেখে দিতে হবে। এভাবে ১৬টি শাখা হলে আর কাটার প্রয়োজন নাই। তবে গাছের গোড়া থেকে শাখা গজালে তা কেটে দিতে হবে। গাছে মরা ও রোগাক্রান্ত শাখা থাকলে তা কেটে দূরে নিয়ে নষ্ট করে দিতে হবে।
ফলন্ত গাছের পরিচর্যা
পেয়ারা গাছের শাখার অগ্রভাগে ফুল আসে না। এমনকি পুরাতন শাখায়ও ফুল আসে না। সাধারণত নতুন মুকুল বা বিটপের পত্রকক্ষে ফুল হয়। পেয়ারা গাছে বছরে দুবার ফুল আসে। মার্চ-এপ্রিল মাসে প্রথম বার এবং সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাসে দ্বিতীয়বার ফুল আসে। ফুলের কুঁড়ি বা মুকুল আসা থেকে ফুল বের হওয়া পর্যন্ত ২০-২২ দিন সময় লাগে। আবার ফুল হতে ফল পাড়ার উপযুক্ত হতে ১৪০-১৬০ দিন সময় লাগে । পেয়ারা গাছে বসন্তকালে এবং বর্ষার প্রারম্ভে ফুল হয়। বর্ষার সময়ের ফল বেশি মিষ্টি হয় না। তাই এ সমস্ত ফল বেশি রাখতে না চাইলে ফুল ভেঙে দিতে হবে। বর্ষার পূর্বের ফুল ভেঙে দিলে বর্ষার পরবর্তীতে বেশি করে ফল ধরে।
মার্চ মাস থেকে সেচ বন্ধ করে গাছের গোড়া হতে হালকাভাবে কিছুটা মাটি সরিয়ে দিয়ে মে মাসে আবার মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। এ মাটি দেয়ার সময় জৈব সার প্রয়োগ করা হলে বর্ষায় ফুল আসবে। এ ফুল হতে যে ফল হবে তা জানুয়ারি মাসে পরিপুষ্ট হবে। এ সমস্ত ফলের আকৃতি ও গুণাগুণ ভালো হয় ।
ফল ছাঁটাই: পেয়ারা গাছ প্রতি বছর প্রচুর সংখ্যক ফল দিয়ে থাকে। গাছের পক্ষে সব ফল ধারণ করা সম্ভব হয় না। তাই মার্বেল আকৃতি হলেই ঘন সন্নিবিশিষ্ট কিছু ফল ছাঁটাই করতে হবে ।
পোকা মাকড় ও রোগবালাই দমন
পোকামাকড় দমন: পেয়ারা গাছে মিলিবাগের আক্রমণ সাধারণত বেশি দেখা যায়। পেয়ারা গাছের পাতা ও ফলে এ পোকা দেখা যায়। এগুলো এক জায়গায় একটি লাইনে অনেকগুলো থাকে। নড়াচড়া করে না। এদের গা তুলোট আবরণযুক্ত। এ পোকাগুলো রস চুষে খেয়ে কচি কাণ্ড, পাতা ও ফলের ক্ষতি করে। মিলিবাগ আক্রান্ত পাতা, কচি কাণ্ড এবং ফল থেকে মিলিবাগ সংগ্রহ করে পুড়িয়ে মারতে হবে। অথবা প্রতি লিটার পানির সাথে নগস বা ডেনকাভাপন ১০০ ইসি ২.০ মি.লি. অথবা ডাইমেক্রন ১০০ এসসিডবিউ, ১.০ মি.লি. হারে মিশিয়ে ভালোভাবে স্প্রে করে মিলিবাগ দমন করা সম্ভব।
রোগ দমন: পেয়ারা উৎপাদনের ক্ষেত্রে রোগ একটি সমস্যা। বহুধরনের রোগ পেয়ারার ক্ষতি সাধন করতে পারে। নিম্নে ক্ষতিকর কয়েকটি রোগের বর্ণনা ও প্রতিকার ব্যবস্থা দেয়া হলো।
উইন্ট রোগ: এর আক্রমণে পাতা শুকিয়ে যায় এবং ছোট ডালপালাও শুকিয়ে যেতে থাকে। এমনকি হঠাৎ একদিন গাছটি মরে যায়। এ রোগ দমনের তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। তবে বাগানের সঠিক পরিচর্যা এ রোগ দমনে সাহায্য করে লীফ স্পট রোগ: এর আক্রমণে পাতা ও ফলে ছোট ছোট বাদামি রঙের দাগ দেখা যায়। এ দাগ গুলোর মাঝখানে কাল দাগ হয়। এ রোগ গাছের ফলের যথেষ্ট ক্ষতি করে থাকে। যে কোন কপার ছত্রাক নাশক ১০-১৫ দিন পর পর ছিটিয়ে এ রোগ দমন করা যায় ।
ফল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
সারা বছর ফল ফলানোর পর সঠিক সময়ে ও নিয়মে ফল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। সুষ্ঠু সংগ্রহ ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা বাণিজ্যিক ফল উৎপাদনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সর্বোৎকৃষ্ট শ্বাস পেতে হলে পরিপক্কতার সঠিক পর্যায়ে ফল সংগ্রহ করতে হবে। অতিপত্ব বা অপক্ব ফল কোনটাই ভাল নয়। পেয়ারা ফল পাকার প্রক্রিয়া অতিদ্রুত । এ জন্য ফল পাকার মৌসুমে প্রতিদিনই ফল সংগ্রহ করতে হয়। ফল পুষ্ট হলে ফলের রং সবুজ থেকে ধীরে ধীরে ফিকে সবুজ বা হলুদাভা হতে থাকে । দূরে পাঠাতে হলে একটু ডার্সা বা কঁচা অবস্থায় ফল পাড়তে হয় । ফল পাড়ার সময় বোটায় ২-১ টা পাতাসহ কেটে নেয়া ভালো। পেয়ারা পাড়ার পর সাধারণত ২-৩ দিনের বেশি রাখা যায় না। পেয়ারা পাকার পূর্বে পুষ্ট অবস্থায় পেড়ে কঁচা পাতা দিয়ে ঢেকে ছায়াময় ঠান্ডা স্থানে এক সপ্তাহ পর্যন্ত ভালোভাবে রাখা যায়। পুষ্ট ফলকে ৮৭ হতে ১০° সেলসিয়াসের তাপমাত্রায় এবং ৮৫-৯০ শতাংশ আপেক্ষিক আর্দ্রতায় একমাস পর্যন্ত রাখা যায়। পেয়ারা থেকে জ্যাম, জেলী তৈরি করে সংরক্ষণ করা যায় ।
লেবু চাষ
বিশ্বের অবউষ্ণ অঞ্চলে, বিষুবরেখার ৪০° উত্তর এবং ৪০° দক্ষিণ অক্ষাংশের যে সমস্ত দেশে সুনির্দিষ্ট শীতকাল রয়েছে যা গাছকে সুপ্ত অবস্থায় যেতে সাহায্য করে সে সমস্ত দেশে লেবুজাতীয় ফলের চাষ সবচেয়ে ভালো হয় । বাংলাদেশের জলবায়ুতে কমলা, জাম্বুরা, লেবু, কাগজী লেবু ইত্যাদি জনে । কাগজি লেবু শুষ্ক অঞ্চলে যেমন- কুষ্টিয়া, পাবনা ও রাজশাহী অঞ্চলে ভালো জন্মে । অথচ বীজহীন লেবু সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভালো জন্মে । অধিক বৃষ্টিপাত সম্পন্ন ঢালু জমিতে যেমন- বৃহত্তর সিলেট, পার্বত্য চট্টগ্রাম কমলা উৎপাদনের জন্য অধিক উপযোগী । জাম্বুরা উত্তর পশ্চিম ও দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলে ভালো জন্মে । পঞ্চগড় জেলায় যেখানে বৃষ্টিপাত বেশি তিতু পানি জমে থাকে না এবং মাটি কিছুটা এসিডিক আজকাল কমলা লেবু চাষের প্রসার ঘটছে।
মাটি ও জমি নির্বাচন
বেলে, বেলে-দোআশ ও লাল পাহাড়ী মাটিতে লেবুর চাষ করা যায়। মাটির উপরের দিকের স্তর দো আশ ও নিচের দিকের তর এঁটেল মাটি হলে লেবু চাষের জন্য উত্তম। লেবু অম্ল মাটি পছন্দ করে । লবণাক্ত ও ক্ষারীয় মাটিতে লেবু ভালো হয় না। স্যাঁতস্যাঁতে মাটিতে লেবু ভালো হয় না। জমি উঁচু ও পানি নিকাশের ভালো সুবিধাযুক্ত হওয়া আবশ্যক! কাদা ও এটেল মাটিতে গাছ ভাল হলেও মাধ্যমিক পরিচর্যার অসুবিধা হয় । তবে কাদা ও এঁটেল মাটিতে নিকাশ ব্যবস্থা থাকলে বিশেষ পরিচর্যার মাধ্যমে লেবু জন্মানো যায় ।
জমি ও গর্ত তৈরি
বাংলাদেশের সমতল এলাকায় বা সমভূমিতে মে-জুন মাসে ধৈঞ্চা বা শন পাটের বীজ বপন করতে হবে। এ সবুজ সারের বীজ বপনের ৫-৬ সপ্তাহ পরে গাছ গুলোকে চাষ দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিলে সবুজ সার তৈরি হয় । সবুজ সার করে লেবুর চাষ করা হলে সেখানে লেবু ভাল হয় । এদেশের পার্বত্য অঞ্চলে লেবুর চাষ করলে সিড়ি বাঁধ দিয়ে জমির ক্ষয় রোধের ব্যবস্থা করতে হয় । বাঁধগুলো চালে আড়াআড়ি ভাবে তৈরি হয় ।
এ সিঁড়ি বাধের ভিতরের দিকে পাহাড়ের ঢালে ঘুরে ঘুরে গর্ত খনন করে গর্তে সার মিশিয়ে চারা রোপণ করতে হয় । চারা রোপণের ২-৩ সপ্তাহ আগে নির্দিষ্ট দূরত্বে ৭৫×৭৫× ৭৫ সে.মি. আকারের গর্ত তৈরি করতে হবে। গর্তের উপরের মাটির সাথে জৈব ও আর্বজনা পচা সার মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে । গর্ত ভরাট করার পর এর উপরের ২০-২৫ সে:মি: মাটির সাথে ২৫০ গ্রাম টিএসপি ও ২৫০ গ্রাম এমপি সার হালকা কোপ দিয়ে মিশিয়ে দিতে হবে ।
ছক: গর্ত প্রতি সার প্রয়োগের পরিমাণ
ক্রমিক নং | সারের নাম | গর্ত প্রতি সারের পরিমাণ |
১ | গোবর/আবর্জনা পচা সার | ১৫-২০ কেজি |
২ | পচা খৈল | ৩০০ গ্রাম |
৩ | হাড়ের গুড়া | ৫০০ গ্রাম |
৫ | ছাই | ২ কেজি |
৫ | টিএসপি | ২৫০ গ্রাম |
৬ | এমপি | ২৫০ গ্রাম |
চারা রোপণের দূরত্বঃ লেবু ও কাগজী লেবু ৪×৪ মিটার দূরত্বে রোপণ করা যায়। কিন্তু কমলা ও জাম্বুরা ৬×৬ মিটার দূরত্বে রোপণ করাই উত্তম ।
চারা রোপণের সময় ও পদ্ধতি
বর্ষা ঋতুর প্রারম্ভে এপ্রিল মে মাসে চারা রোপণ করা উত্তম । তবে সেচ সুবিধা থাকলে সেপ্টেম্বর - অক্টোবর (ভাদ্র - আশ্বিন) মাসেও রোপণ করা যায়। এক বছর বয়সের কলমের চারা গর্তের ঠিক মাঝখানে রোপণ করতে হবে । চারা গাছ সোজা ভাবে বসিয়ে গাছের গোড়ায় মাটি ভালোভাবে চেপে দিয়ে হালকা সেচ দিতে হবে । তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন গর্তে গাছের গোড়ায় পানি দাড়ানো না থাকে । প্রত্যেক গাছে একটি করে শক্ত কাঠি দিয়ে বেধে দেওয়া দরকার। আম, কাঁঠাল, নারিকেল ইত্যাদি স্থায়ী বাগানে পঞ্চমস্থানে বা ষড়ভুজী পদ্ধতির মাঝখানে পুরক গাছ হিসাবে ও লেবু গাছ লাগানো যায় ।
সার প্রয়োগ
লেবু গাছে যে পরিমাণ সার দিতে হবে তা সারণি- ২ তে দেখানো হলো
সারণি- ২ বিভিন্ন বয়সের লেবু জাতীয় ফল গাছে সারের পরিমাণ
ক্রমিক নং | সারের নাম | ১-২ বছর বয়স | ৩-৫ বছর বয়স | ৬ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়স |
১ | গোবর বা আবর্জনা (কেজি) | ১৫ | ২০ | ২৫-৪০ |
২ | ইউরিয়া (গ্রাম) | ২০০ | ৪০০ | ৫০০ |
৩ | টিএসপি (গ্রাম) | ২০০ | ৩০০ | ৪০০ |
৪ | এমপি(গ্রাম) | ২০০ | ৩০০ | ৪০০ |
বর্ষা মৌসুমের শুরুতে জ্যৈষ্ঠ (মে) মাসে সম্পূর্ণ গোবর সার একবারে প্রয়োগ করতে হবে । অন্যান্য সার তিন কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ (Top dressing) পদ্ধতিতে আশ্বিন (সেপ্টেম্বর), মাঘ (ফেব্রুয়ারি) এবং বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ (মে) মাসে
প্রয়োগ করতে হবে । পাহাড়ের ঢালে গোবর সার গাছের চারদিকে মাটির সাথে কোদাল দিয়ে ভালোভাবে মিশে দিতে হবে । এরপর আগাছা বা আর্বজনা দিয়ে ভালো করে ঢেকে দিতে হবে। যাতে বৃষ্টি হলে ধুয়ে না যায় । অন্যান্ন সার ড্রিবলিং (Dribbling) পদ্ধতিতে দিলেই চলবে
গাছ রোপণ পরবর্তী পরিচর্যা
সারের উপরি প্রয়োগ চারা রোপণের ৩-৪ মাস পর গাছ প্রতি ২০০ গ্রাম ইউরিয়া, ২৫০ গ্রাম করে টিএসপি ও এমপি সার দিতে হবে। চারার ৯ থেকে ১০ মাস বয়সে প্রয়োজনে অতিরিক্ত ২০০ গ্রাম ইউরিয়া সার দিতে হবে । গাছের বয়স বাড়ার সাথে সাথে সারের পরিমান বাড়িয়ে দিতে হবে ।
সেচ: মাটি যদি শুকিয়ে যায় কিংবা মাটিতে রস না থাকে এবং পাতা শুকিয়ে যায় তাহলে অবশ্যই সেচ দরকার । শীত কালে ফুল আসা থেকে বর্ষা শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত প্রয়োজনমত সেচ দিতে হবে। এতে গাছের বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে । ফল আকারে বড় হয় এবং ফলের গুণাগুণ বৃদ্ধি পায় । বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি হলে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে ।
অঙ্গ ছাঁটাই: হেঁটে গাছকে সঠিকভাবে বাড়তে দিয়ে সুন্দর ও শক্ত কাঠামো তৈরির জন্য অবাঞ্ছিত শাখা প্রশাখা ছাঁটাই করে দিতে হবে । তাছাড়া সব বয়সের গাছই বর্ষার পর ও আগে বিশেষভাবে ফল আহরণের পরপরই মরা ও রোগাক্রান্ত ডালপালা ছাঁটাই করে দিতে হবে ।
ফল ছাঁটাই: গাছে অতিরিক্ত ফল আসলে এগুলোর মধ্য হতে কিছু ফল ছাঁটাই করে দেয়া ভালো। এতে ফল বড় হয়, গাছ নিয়মিত ফল দেয় এই গাছ দীর্ঘজীবী হয় ।
পোকামাকড় ও রোগ দমন
পোকামাকড় ও পাতা কুন্দী (Leaf miner) পোকা ও লেবু গাছের একটি মারাত্মক পোকা। এ পোকার শুককীট চারা গাছের এমনকি বড় গাছের নরম পাতা, ডাল তাড়াতাড়ি খেয়ে গাছকে প্রায় পাতা শূণ্য করে ফেলে । আক্রান্ত গাছে রগর/রক্সিয়ন ৪০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ২ মি:লি: ঔষধ মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে । ফলের মাছি পোকা লেবুর ভয়ানক শত্রু । বিষটোপ ব্যবহার করে পূর্ণাঙ্গ মাছি পোকা দমন করা যায় ।
রোগ দমন: লেবু জাতীয় গাছের ডাইব্যাক একটি মারাত্মক রোগ। এই রোগের আক্রমণে গাছ শীর্ষভাগ হতে মারা যেতে থাকে এবং পরবর্তীতে সম্পূর্ণ গাছ মারা যায়। রোগ দেখা মাত্র ১০-১২ দিন পরপর বার্দে মিশ্রণ স্প্রে করে এ রোগ দমন করা যায় । গামোসিস রোগের আক্রমণে বাকল ফেটে রস পড়তে থাকে এবং আস্তে আস্তে শুকিয়ে যায় । এই রোগ দেখামাত্র আক্রান্ত স্থান চেঁছে দিয়ে বার্সে পেস্ট লাগাতে হবে ।
ফল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
লেবু ও কাগজী লেবু গাছে জানুয়ারি - ফেব্রুয়ারি মাসে ফুল ও ফল আসে এবং জুন- জুলাই মাসে এগুলো সংগ্রহ করা যায় । জাম্বুরাতে জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি মাসে ফুল আসে এবং সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাসে ফল আহরন করা হয় । কমলার গাছে মার্চে ফুল আসে এবং নভেম্বর - ডিসেম্বর ফল পাকে ।
ফল পুস্ট হলে রং বদলাতে শুরু করে। ফল যতই পুস্ট হবে চামড়ার উজ্জ্বলতা ততই বৃদ্ধি পাবে এবং চামড়া টানটান হবে । পুষ্ট লেবু কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত টাটকা থাকে। সংগ্রহের পর ফল পরিষ্কার করে বিক্রয়ের জন্য ছোট বড় গ্রেডিং করতে হয় । পরিণত ফল ১১° সেলসিয়াস তাপমাতায় ও ৮০- ৯০ শতাংশ আপেক্ষিক আর্দ্রতায় হিমাগারে দুমাস পর্যন্ত তাজা অবস্থায় রাখা যায় ।
ফলন ও কাগজী লেবু গাছ প্রতি ২০০০ - ৪০০০টি
লেবু/পাতি লেবু ও ১০০-১০০০টি
জাম্বুরা : ১০০-৩০০টি, কমলা ও ১০০-৫০০ টি
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। অবৃক্ষ জাতীয় ফলের মধ্যে প্রধান প্রধান ফল কোনটি ?
২। চারা রোপণের কত দিন পূর্বে গর্ত খনন ও সার মিশ্রিত করে ভরাট করতে হয় ?
৩। পেঁপে চারা রোপণের কত দিন পর ফুল ও ফল আসে ?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। কলা গাছের সাকার সম্পর্কে লেখ।
২। আনারসের কয় ধরনের সাকার পাওয়া যায় লেখ ।
৩। পেঁপে গাছে সারের উপরি প্রয়োগ সম্পর্কে লেখ ।
৪ । পেয়ারার চারা রোপণের দূরত্ব ও সময় সম্পর্কে লেখ ।
৫। পেঁপের জাতের নাম লিপিবদ্ধ কর।
৬ । কলার চারা রোপণ পদ্ধতি লেখ ।
৭ । কলার চারা শনাক্তকরণ পদ্ধতি লেখ।
৮। কলার পানামা রোগের কারণ ও লক্ষণ লেখ ।
৯ । পেয়ারার ক্যাংকার রোগের কারণ ও দমন পদ্ধতি লেখ।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। কলা চাষের জন্য চারা নির্বাচন, চারা প্রস্তুতকরণ, চারা রোপণ, ও অন্তবর্তী পরিচর্যা সম্পর্কে লেখ ।
২ । আনারসের জন্য জমি ও মাটি নির্বাচন, চারা রোপণের দূরত্ব, চারা রোপণ পদ্দতি ও রোপণ পরবর্তী পরিচর্যা সম্পর্কে লেখ ।
৩। পেঁপে চাষের জন্য জমি তৈরি, গর্ত খনন, চারা রোপণ কৌশল, চারা রোপণের দূরত্ব ও রোপণ পরবর্তী পরিচর্যা সম্পর্কে লেখ ।
৪ । পেয়ারা চাষের জন্য মাটি ও জমি নির্বাচন, গাছের শাখা বিন্যাসের জন্য ছাঁটাই পদ্ধতি ও রোপণ পরবর্তী পরিচর্যা সম্পর্কে লেখ ।
৫ । আনারস, কলা, পেঁপে ও পেয়ারার আহরণ ও সংরক্ষণ পদ্ধতি লেখ ।
৬। পেঁপের পোকামাকড় ও রোগ দমন সম্পর্কে আলোচনা কর ।
৭ । টীকা লেখ: ক) পানি চারা খ) আনারসের সাকার